অমিত চরিত
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোটবেলা থেকেই অমিতের বদমাইশি ছিল অন্য মাত্রার। তাই তাকে বাগে আনাটাও ছিল কঠিন। আমাদের গ্রামে তখন ময়রা স্যার বলে একজন মাস্টার মশাই ছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন ময়রা বাড়ির ছেলে। যারা মিষ্টি টিষ্টি তৈরী করতো আর কি। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত পন্ডিত মানুষ। তখনকার দিনে বি.এ, এল.এল.বি পাশ করেছিলেন। কিন্তু গ্রামের ছেলেদের পড়ানোর স্বার্থে ওকালতি না করে গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করতেন আর খুব কম পয়সায় গ্রামের ছেলেদের টিউশন দিতেন। অমিতও পড়তো সেই ময়রা স্যারের কাছেই। স্যার ইস্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে, জামা কাপড় ছেড়ে ছাত্রদের পড়াতে বসে যেতেন। আর স্যারের স্ত্রী রোজ পরোটা ভেজে পাঠিয়ে দিতেন দোতলায় স্যারের পড়ানোর ঘরে। একদিন রাতে খেতে বসে ময়রা স্যার তাঁর স্ত্রী’কে বললেন, ‘তুমি আমাকে তিনটে করে পরোটা দাও কেন? কোন সকালে খেয়ে স্কুলে যাই, তিনটে পরোটায় আমার খিদে মেটেনা’। স্যারের স্ত্রী তো আকাশ থেকে পড়লেন, ‘কি বলছো! আমি তো চারটে পরোটাই দিই’। স্যার ‘হুঁ’ বলে চুপ করে গেলেন। পরের দিন চোর ধরা পড়লো। রান্নাঘর থেকে স্যারের পরোটা আনার দায়িত্বটা ছিল অমিতের। পরের দিন স্যার অমিতকে পরোটা আনতে পাঠালেন, আর ঠিক দুমিনিট পর নিজে নেমে গেলেন সিঁড়িতে। গিয়ে দেখলেন অমিত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তাঁর চারটে পরোটার একটি সাবার করছে। স্যার তার কান ধরে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রী’কে বললেন, ‘শোনো, কাল থেকে বাঁদরটাকে দু’টো করে পরোটা খাইয়ে তবে ওপরে পাঠাবে, আমার ভাগে যেন কম না হয়’ আসলে অমিত খুব বড়ো পরিবারের ছেলে, তার উপর স্যারের স্ত্রী অমিতকে নিজের ছেলের মত ভালোবাসতেন, তাই সেদিন তার বদমাইশির আবদারকে প্রশ্রয় দিতে স্যারকে ভাবতে হয়নি। অমিতের বদমাইশি ছিল এমনই। ধরো মা রসবড়া করে রেখেছেন দালানের চৌকির তলায়। ঘুরতে ফিরতে অর্ধেক রসবড়া খেয়ে ফেলার পর যখন অমিতের হুঁশ হলো আর মায়ের হাতে মার খাওয়ার ভয়টা যখন মনের মধ্যে সুড়সুড়ি দিতে আরম্ভ করলো তখন সে নিজের পিঠ বাঁচাতে ছোট বোন দুটিকে এগিয়ে দিল রসবড়ার দিকে, আর মা’কে গিয়ে খবর দিলো, সে তার ছোট বোন দুটিকে দালানের চৌকির তলায় বসে কিছু খেতে দেখে এলো। মা তো সেই শুনে লাফাতে লাফাতে গিয়ে ছোট দুটিকে ধরে পিটতে আরম্ভ করলেন। অমিতের পিঠ বাঁচলো কিন্তু মনটা খারাপ হলো খুব। পরের দিন দোকান থেকে দু পয়সার লজেন্স কিনে বোনেদের দিয়ে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করলো অমিত। অবশ্য শুধু ছোটবেলায় বা গ্রামের মধ্যে নয়, বড়ো হওয়ার পর, এমনকি চাকরির জায়গাতেও অমিতের বদমাইশির খামতি ছিল না। আদ্রার ঘটনা তো আগেই বলেছি। তারপর অমিত বদলি হয়ে এলো হাওড়া স্টেশনে। বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতে লাগলো, আর সেই সঙ্গে আবার শুরু হলো নাটক। এবার অবশ্য শুধু গ্রামে নয়, তার সাথে কোলকাতাতেও। কোলকাতার বিখ্যাত বিশ্বরূপা থিয়েটারে গোরা নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করে অমিত খুব সুনাম অর্জন করেছে। আর ঠিক সেই সময়েই অমিতের ঘাড়ে চাপলো এক নতুন বিড়ম্বনা। অমিতের অফিসে নতুন বড়োবাবু হয়ে যিনি এলেন তাঁর বাড়ি আমাদের স্টেশনে নেমেই যেতে হতো। অমিতের বাড়ি তাঁর বাড়ির কাছাকাছি জানার পরেই তিনি অমিতকে দিয়ে প্রায়ই বাড়ির নানান কাজ করাতে লাগলেন। কাজ মানে প্রায় দিনই বড়োবাজার থেকে সংসারের জিনিসপত্র কিনতেন বড়োবাবু। আর সেই সব জিনিস ভর্তি ভারি ভারি ব্যাগ ঘাড়ে করে হাওড়া স্টেশন, তারপর ট্রেনে করে এসে আমাদের স্টেশনে নামিয়ে বড়োবাবুর বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসতে হতো অমিতকে। অবশ্য অমিত একা নয়, সঙ্গে থাকতো বিশ্বাস, যার বাড়ি আমাদের দুটো স্টেশন পর। ব্যাপারটা ক্রমেই অমিতের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠলো। সে ভাবতে লাগলো কি করে এর থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। একদিন হঠাৎ অমিতের মাথায় একটা উদ্ভট বুদ্ধি চাপলো। সেদিনও বড়োবাবু ব্যাগভর্তি মালপত্র কিনে অমিতদের সঙ্গে বড়োবাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। হাওড়া ব্রিজ পার করে এসে পৌঁছলেন স্টেশনে। সামনে বড়োবাবু পিছনে ব্যাগ ঘাড়ে করে দুই কুলি অমিত আর বিশ্বাস। স্টেশনে ঢুকেই অমিত হঠাৎ বিশ্বাসের জামা টেনে ধরলো। বিশ্বাস তাকাতেই অমিত তাকে নিয়ে লুকিয়ে পড়লো একটা থামের আড়ালে। ওদিকে বড়োবাবু তো নিজের মনে হেঁটে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছেন। হঠাৎই তিনি খেয়াল করলেন যে পিছনে অমিত আর বিশ্বাস নেই। ‘আরে গেল কোথায় ছোঁড়াদুটো?’ বড়োবাবু ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে গেল কিন্তু বড়োবাবু ওদের খুঁজে পেলেন না, তাঁর চিন্তা বাড়তে লাগলো। হঠাৎ বড়োবাবু স্টেশনের মাইকে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলেন। গোটা হাওড়া স্টেশন জুড়ে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, ‘হাওড়া স্টেশন ম্যানেজার অফিস বড়োবাবু শ্রী অমিয় মজুমদার আপনার জন্য অমিতবাবু আর রঞ্জন বিশ্বাস আপনার বাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্মে অপেক্ষা করছে।’ একবার, দুবার, তিনবার। বড়োবাবুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ‘ছোঁড়াগুলো করেছে কি! একেবারে মাইকে? ছি ছি ছি, একেবারে গোটা অফিস জেনে ফেললো যে ওদের দিয়ে বাড়ির কাজ করাই!’ তিনি ছুটলেন এক নম্বর প্লাটফর্মের দিকে। পেয়েও গেলেন দুজনকে। আর পেয়েই একেবারে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলেন, ‘মাইকে এনাউন্স করাতে তোদের কে বললো?’ অমিত কাঁচুমাচু মুখ করে মাথা চুলকে বললো, ‘না মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই–‘ বড়োবাবু তো রেগে আগুন, বললেন, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে যা। মালপত্রগুলো ট্রেনে তুলে দিয়ে তোরা অফিস ফিরে যা’। অমিতরা তাই করলো। বড়োবাবুকে মালপত্র সমেত ট্রেনে তুলে দিয়ে লাফাতে লাফাতে অফিস ফিরে গেল। আর সেই শেষ হলো বড়োবাবুর মাল বওয়া। তারপর থেকে আর কোনোদিন তাদের বড়োবাবুর কুলি হতে হয়নি। অমিত ছিল এইরকমই। ঘরে বাইরে সবসময়ই বদমাইশি বুদ্ধি তার মাথায় কিলবিল করতো। অবশ্য শুধু যে বদমাইশি তা নয়, ভালো কাজেও অমিতের তুলনা ছিল না। গ্রামে কার মেয়ের বিয়ে পয়সার জন্য আটকে গেছে, কি কার শরীর খারাপ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, সব জায়গাতেই ছিল অমিত আর তার বন্ধুরা। না আজকে তাকে আর ‘অমিত’ বলবো না, ‘অমিতবাবু’ বলি, কেননা তাঁর বয়স এখন আশি এবং তিনি সুস্থ শরীরেই আছেন। বয়স বদলেছে কিন্তু অমিত বাবু বদলাননি। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে উদ্দিন আর বরকত ছাড়া বাকিরা প্রায় সকলেই ইহকালের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। তবে গ্রামের প্রতি তাঁদের দান আজও রয়ে গেছে। অমিত বাবু আর তাঁর বন্ধুরা হঠাৎই একদিন ইট আর মাটি দিয়ে গ্রামের মধ্যে একটা নাটকের মঞ্চ তৈরি করে ফেলেছিলেন, যেটা আজও স্বমহিমায় বিরাজমান। অমিত বাবু ভালোই আছেন। বন্ধুরা নেই তো কি হয়েছে? অল্পবয়সী ছেলেদের সঙ্গেই আড্ডা দেন, মাছ ধরতে যান, আর মাঝে মাঝে উঁকি দেন নাটকের রিহার্সাল ঘরে। হ্যাঁ, অমিত বাবুদের তৈরি সেই মঞ্চে আজও নাটক হয়। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের প্রথম শুক্র আর শনিবার সেই মঞ্চ আজও মাতিয়ে রাখে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। এক কাজ করুন না, সবাই মিলে চলে আসুন যেকোনো বছর নভেম্বর মাসের প্রথম শুক্র শনিবার। নাটক দেখবেন আর অমিত বাবুর সামনে বসে তাঁর নিজের মুখেই শুনে নেবেন তাঁর জীবনের মজার মজার সব গল্প। সবার নিয়ন্ত্রণ রইলো। কি আসবেন তো?
ভীষণ ভাল লাগলো।